ঈদুল ফিরতঃ মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ উৎসব , কখন থেকে এ উৎসব , এ উৎসবে করনীয় ।

 ঈদুল ফিরতঃ মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ উৎসব , কখন  থেকে এ উৎসব , এ উৎসবে করনীয়

 জলিল মাহমুদ

ঈদ আরবি শব্দ। ঈদ শব্দের বিভিন্ন অর্থ রয়েছে। একটি অর্থ হলো ফিরে আসা। এই দিবসটি মুসলমানদের জীবনে বার বার ফিরে আসে। মুসলমানরা এ দিবস একত্রে উদযাপন করে। ঈদের আর একটি অর্থ হলো আনন্দ বা খুশি। ফিতর শব্দের অর্থ ভেংগে দেয়া। ঈদুল ফিতর নামে যে আনদ উৎসব যা মুসলমান্দের জীবনে এক সুবিশাল আনন্দের দোলা দিয়ে যায়। সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ইহার এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। সকল প্রকার জরা জীর্নতা পাপ ধুয়ে মুছে ইমানদারদের জীবিনে নব উদ্যমের সঞ্চার করে এই ঈদ। ঈদুল ফিতরের আগে এক মাস ব্যাপি রোজা রেখে আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জনের এক কঠিন পথ পাড়ি দেয় মুসলমানেরা। এই রোজা তথ সব প্রকার পানাহার বর্জন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এক মাত্র আল্লাহর সন্তোষ্টি লাভের আশায়। পানাহারের বর্জনের সাথে সাথে সকল প্রকার পাপ ত্থেকে মুসলমানেরা পরিশুদ্ধতা অর্জনের এক প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে।

সকল প্রকার অহংকার, ধনী গরীবের ব্যবধান থেকে নিজেদের মুক্ত করে ন্যায় ও সাম্যতার সমাজ প্রতিষ্ঠার মানসে আসে পবিত্র ঈদুল ফিতর। এক মাস সিয়াম সাধনার পর আত্মার পরিশুদ্ধতার মাধ্যমে জান্নাতি এক আবেশে সকল শ্রেণির মানুষ এক কাতারে কাঁধে কাঁদ মিলিয়ে এক আল্লাহর দরবারে হাজির হয়। সুরা আল আনআম এ ১৬২ নম্বর আয়াতে এবাদত সম্পর্কে বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার সাধনা, আমার জীবন- মরণ একমাত্র মহান প্রতিপালক আল্লাহর জন্য”। মুমিমনদের জীবনে ঈদ আসে সকল প্রকার ত্যাগের বার্তা নিয়ে । ঈদ যেন সকল প্রকার মানূষ সমান ভাগে উপভোগ করতে পারে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাই আল্লাহ  মুমিদের জন্য ফিতরা ও যাকাত সহ দান করার জন্য উৎসাহ দেয়া হয়েছে যাতে ন্যায় ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঈদ তাই ধনী গরীব সকলের জন্যই আল্লাহর তরফ থেকে এক রহমত। মহা নবীর সাহাবীগন ঈদের দিন সাক্ষাৎ করে একে অপরে বলতেন “ তাকাববালাল্লাহ মিন্না অয়া মিনকা –অর্থ আল্লাহ আমাদের ও আপনার ভালো কাজগূলো কবুল করুন”। পবিত্র ঈদ আনন্দের ঈদ, ক্ষমার ঈদ, সব ভেদাভেদ ভুলে সকলে এক কাতারে দাঁড়ানোর ঈদ।

কখন থেকে ঈদের প্রচলনঃ

আলাহ তা আলা মুমিন মুসলমানদের জন্য খাস নিয়ামত হিসেবে ঈদ দান করেছেন। জানা যায়, মহানবী (সঃ) মদিনাতে হিজতের পর হিজরতের পরই ঈদ শুরু হয় ঈদ। হিজতের পর মহানবী (সঃ) মদিনাতে অবস্থানকালে দেখলেন “নওরোজ” ও “মেহেরজান” নামে দুটি আনন্দ উৎসব প্রচলন আছে। এ দিবসগুলোতে শুধু আনন্দ, খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তির আয়োজন করা হতো ।  এই দুই দিনের পরিবর্তে আল্লাহ শ্রেষ্ঠ দুটো দিন ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা ড্যাং করেছেন। তাহলে এটা প্রতিয়মান হয় শুধু আনন্দ উৎসব হয়। এটি ত্যাগ ও মহিমায় নিজেদের সাজাতে এ উৎসব। সুরা বাকারর ১৮৫ নং আয়াত অনুসারে ঈদের ইদ্দেশ্য আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা আর আল্লাহর দেয়া নেয়ামত থেকে দান করে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করা। আমাদেরকে আল্লাহর নির্দেশ ও রাসুল (সঃ) এর সুন্নতের উপরেই আমাদের ঈদ উদযাপন করতে হবে। কিন্তু আমরা দেখে থাকি ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় তাবু টানিয়ে গান বাজনা ও বিভিন্ন ইসলামিক সমর্থন করে না এমন আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তাহলে ঈদের আসল উদ্দেশ্য থেকে আমরা দূরে সরে যাই। 

ঈদে আমাদের করনীয়ঃ

ঈদের দিন আমাদের করনীয় নিম্নরূপঃ

১। প্রতি দিনের মতো যথা রীতি ফজরের নামাজ আদায় করা । সম্ভব হলে জামাতে আদায় করা ।

২। ঈদের দুই রাকাত নামাজ জমাতের সহিত আদায় করা।

৩। ঈদের নামাজের আগে গোছল করার মাধ্যমে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা প্রয়োজন । সাহাবিদের জীবনী থেকে জানা যায় তারা পায়ে ঠেঁটে ঈদের নামাজে যেতে বেশি পছন্দ করতেন।

৪। ঈদে পরষ্পরকে শুভেচ্ছা জানানো একটি উত্তম কাজ।

৫। তাকবীর পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা হয়। তাকবীর হলো : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার। ওয়া লিল্লাহিল হামদ। বাক্যটি উচ্চস্বরে পড়া। আবদুল্লাহ ইবনে উমার রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছা পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতেন।’

৬। ঈদে উত্তম জামা-কাপড় পরিধান করে ঈদ উদযাপন করা। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদি আল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘আল্লাহ রাববুল আলামিন তাঁর বান্দার উপর তাঁর প্রদত্ত নিয়ামাতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন।’ মহানবী (সঃ) নিজে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন।

৭।ঈদের খুতবা বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। এতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়ে থাকে। এই খুতবা শোনার ব্যপারে মহানবী (সঃ) তাগিদ দিয়েছেন।

৮। ঈদের দিন আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের মাফ করে দেন । মহানবী (সঃ) এই দিন আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে বেশি বেশি দোয়া ইস্তেগফার করতে বলেছেন ।

৯। ঈদের দিন মুসাফা ও মুয়ানাকা করার মাধ্যমে মুসলমানঅদের নিজেদের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। যদিও বর্তমান করোনা পরস্থিতির কারনে কোলাকোলি পরিহার করে চলা উচিত। তবে এগুলো সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য বিধি বজায় রেখেও করা যেতে পারে।  

১০। ফিতরা দেয়া একটি ইসলামের অন্যতম সুন্দর রেওয়াজ। এর মাধ্যমে অনেক পরিবার ঈদের আনন্দ উপভোগের সুযোগ হবে।

১১। আত্মীয় স্বজনদের ও প্রতিবেশিদের খোঁজ খবর নেয়া, তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা ঈদের দিনে মুমিনদের অন্যতম কাজ। সাথে সাথে অভাবগ্রস্থদের ও ইয়াতিমদের খোঁজ খবর নেয়ার ব্যপারে বিশেষ তাগিদ দেয়া হয়েছে।

১২। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে অনেক সময় মন-মালিন্য হয়ে থাকে । ঈদের দিন এই মন- মালিন্য দূর করার এক অফুরান্ত সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ। মহানবী (সঃ) বলেছেন, “কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে দেখা সাক্ষাৎ হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ঐ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয় (সহীহ মুসলিম : ৬৬৯৭)।”

ঈদ মুসলিম জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উতসব। এই উৎসবের মাধ্যমে মুসলমানদের সামাজিক ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়। তবে এই উৎসবে যেন অনৈসলামিক সংস্কৃতি প্রবেশ না করে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। ঈদ পালনে ইসলাম সমর্থন করে না এমন সব বিনোদন বা সংস্কৃতিতে মুসলমান হিসাবে আমাদের বর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। ঈদ পালন করতে হবে নবী (সঃ) এর নির্দেশনা অনুযায়ী। মুসলমান হিসাবে আমাদের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি রয়েছে। ঈদ মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি ও সাম্যের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার এক উপায়।

(লেখকঃ জলিল মাহমুদ। শিক্ষক ও কলাম লেখক)

 

Post a Comment

0 Comments